রাহু! এমন একটি নাম, যেটা শুনলেই আমাদের মনে ভয়ের সঞ্চার হয়। যার দশা আসার আগেই আমরা চিন্তিত থাকি, কোনকিছু অনিষ্ট না হয়ে যায়। রাহুর দশার কুফল নিয়ে সবার মনেই একটা ভয়-ভীতি কাজ করে। আর এটা স্বাভাবিকও যে রাহুর দশায় মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, অনিষ্ট দেখা যায়। অবশ্য রাহুর দশায় অনেকের জীবনে সাংসারিক বিভিন্ন ধরনের লাভ প্রাপ্তিও হয়ে থাকে।
সৌর জগতে রাহু এবং কেতুর কোন অস্তিত্ব নেই।বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্রে রাহু-কেতুকে ছায়া গ্রহের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।পৌরাণিক কথা অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণু যখন দেবতাদের মধ্যে অমৃত বণ্টন করছিলেন,তখন স্বরভানু নামের রাক্ষস চন্দ্র এবং সূর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে অমৃত বণ্টনকালীন সময়ে দেবতা সেজে অমৃত খেয়ে নিয়েছিলেন ।
ভগবান বিষ্ণুকে যখন এই কথাটি চন্দ্র এবং সূর্য জানান,তখন ভগবান বিষ্ণু উনার সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে সেই স্বরভানু নামের রাক্ষসের গলা কেটে দেন।কিন্তু গলা কাটার আগেই স্বরভানু অমৃত খেয়ে ফেলায় উনি ওমর হয়ে যান শরীরের দুই টুকরো রূপে।মাথা থেকে গলা পর্যন্ত একভাগ,যাকে আমরা রাহু নামে জানি এবং গলা থেকে পা পর্যন্ত দ্বিতীয় ভাগ যাকে আমরা কেতু নামে জানি ।
সূর্য ও চন্দ্র দেবতা ভগবান বিষ্ণুকে স্বরভানুর অমৃত পানের ঘটনা জানানোর কারণে উনার শরীরের দু-টুকরো হয়েছিল। সেজন্য স্বরভানু বলেছিলেন যে সুযোগ পেলেই সূর্য এবং চন্দ্রের গায়ে গ্রহণ লাগাবেন। যেটা আজও চলছে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ নামে।
আধুনিক সভ্যতা হয়তো বা এই কথাকে মানতে চাইবে না। কিন্তু প্রত্যেক সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের সময়ে গ্রহের অবস্থান যদি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন যে সূর্য গ্রহণের সময় সূর্য হয়তো কেতুর একদম ক্লোজ ডিগ্রির মধ্যে, নয়তো রাহুর ক্লোজ ডিগ্রির মধ্যে। তেমনি চন্দ্রগ্রহণের সময় চন্দ্র, রাহু, বা কেতুর ক্লোজ ডিগ্রির মধ্যে। এককথায়, সূর্য এবং চন্দ্র রাহু, কেতুর ক্লোজ ডিগ্রির মধ্যে এলেই সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ শুরু হয়।
কুণ্ডুলী চক্রে রাহু-কেতুর নিজস্ব কোন ঘর বা ভাব নেই। রাহুকে কুম্ভ রাশির সহ অধিপতি এবং কেতুকে বৃশ্চিক রাশির সহ অধিপতি হিসাবে দেখা হয়। অনেকে বৃষ রাশিকে রাহুর উচ্চস্থ ঘর আবার অনেকে মিথুন রাশিকে এবং অনেকে বৃশ্চিক রাশিকে কেতুর উচ্চস্থ ঘর আবার অনেকে ধনু রাশিকে কেতুর উচ্চস্থ ঘর মানেন।
জ্যোতিষ শাস্ত্রে রাহুকে সাংসারিক সুখ ভোগের কারক হিসাবে মানা হয়। রাহুর দশায় মানুষ সাংসারিক বিভিন্ন ধরনের বিষয়ের প্রতি অধিক আকৃষ্ট হয়ে উঠেন। ধনের প্রতি আকর্ষণ, খাওয়া-খাদ্যের প্রতি আকর্ষণ, বিনোদনের প্রতি আকর্ষণ, অর্থাৎ সাংসারিক সুখ ভোগের বিষয় প্রাপ্তির প্রতি মানুষ অধিক আকৃষ্ট হয়ে উঠেন।
অধিক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় মগ্ন হওয়ার কারণে আধ্যাত্মিকতার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে।ডিসিপ্লিন,ন্যায়-নীতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ধর্ম থেকে মানুষ ধীরে ধীরে দূরে সরতে থাকেন।ফলস্বরুপ শারীরিক ক্ষেত্রে শুরু হয় বিভিন্ন সমস্যা।কর্মে ঘটে ব্যাঘাত।মানুষিক অবস্থার হয় অবনতি ।শুরু হয় সাংসারিক বা পারিবারিক বিভিন্ন ঝামেলা।অধিক পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হওয়ার কারণে অনেকের জীবনে অধিক অনিষ্ট হতেও দেখা যায় ।
প্রকৃত সুখের মূল রসদ হল জীবনযাত্রায় সঠিকভাবে ডিসিপ্লিন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। ন্যায়-নীতি এবং ধর্ম মেনে কর্ম করা।এগুলি মেনে চললে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা থাকে ভালো।শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো হলে কর্মও ভালো হয়।আর কর্ম ভালো হলে,সবকিছুই ভালো হয়।
রাহুর দশা বা অন্তর্দশায় বা গোচরের রাহুর অশুভ প্রভাবের কারণে দৈনন্দিন জীবনের নিয়মাবলীর মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে। যার ফলস্বরূপ দেখা দেয় বিভিন্ন সমস্যা। রাহুর কুপ্রভাব থেকে বাঁচার সরল মাধ্যম হল কেতুর বৈশিষ্ট্যের সাথে যুক্ত হয়ে চলা। কেতু হল আধ্যাত্মিকতার কারক গ্রহ। আমাদেরকে ঈশ্বরের সাথে যুক্ত করার মাধ্যম। ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হতে চাইলে আগে আমাদের জীবন ধারণে পরিবর্তন আনতে হয়। আমাদের জীবন যাত্রায় ডিসিপ্লিন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ন্যায়-নীতি এবং ধর্মকে প্রাধান্য দিতে হয় বা পাথেয় করতে হয়। তবেই আমরা ঈশ্বরের সান্নিধ্যে যাওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারি।
কেতু যেহেতু ঈশ্বরের সাথে যুক্ত করার মাধ্যম, তাই কেতুর সাথে যুক্ত হতে হলেও আমাদেরকে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলির পালন করতে হয়। রাহুর দশায় বা অন্তর্দশার বা গোচরের রাহুর নেগেটিভিটি থেকে রক্ষায় বা লগ্ন বা রাশিতে অবস্থানরত রাহুর কুপ্রভাব থেকে রক্ষা পেতে কেতুর বৈশিষ্ট্যের সাথে যুক্ত হয়ে চলতে হয়। তাতে রাহুর দশার বা গোচরের রাহুর মায়াজাল আমাদের অনিষ্ট করতে পারে না। মায়াজাল বলার কারণ রাহুর দশায় অনেক কিছু পাওয়ার আশায় অধিক কিছু শেষ হয়ে যায়। অতএব রাহুর দশাকে মায়াজাল ছাড়া কি আর বলা যায়?
কেতুর বৈশিষ্ট্যের সাথে যুক্ত হয়ে চলা,অর্থাৎ ডিসিপ্লিন,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা,ন্যায়-নীতি এবং ধর্মের সাথে যুক্ত হয়ে চলা বা আধ্যাত্মিকতার সাথে যুক্ত হয়ে চলা।রাহুর দশার অধিক কষ্ট অনুভব করলে আমিষ জাতীয় ভোজন কম খাওয়া বা ত্যাগ করা এবং নিরামিষ ভোজন করা।নেশাজাতীয় খাবার কোনভাবেই না করা ।
অতএব রাহুর দশা বা অন্তর্দশায় বা লগ্ন বা রাশিতে রাহু অবস্থান রত জাতক-জাতিকারা সর্বএদা কেতুর বৈশিষ্ট্যের সাথে যুক্ত হয়ে চলুন।রাহু আপনাদের অনিষ্ট করতে পারবে না।বরং আধ্যাত্মিকতার সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে জীবনে পেতে পারেন প্রকৃত সুখের সন্ধান।
No comments:
Post a Comment